বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই, ২০১৮

ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী স্বামীকে পূরণ করতে হবে স্ত্রীর মৌলিক ১০ টি হক




বিয়ের পর বাসর রাত মুমিন জীবনের অন্যতম রাত। যারা পরকীয়া করে, লিভ টুগেদার করে, তারা এ রাতের মর্ম বুঝবে না। যারা বেশ্যা বা বহুগামিতা তাদের কাছে এ রাত বাতুলতা মাত্র। আমরা এ পর্বে বাসর রাতে অবশ্যই পালনীয় কিছু টিপস নিয়ে আলোচনা করব।


০১. গোলাপ ফুল দিয়ে দুজন দুজনাকে বরণ করে নিতে হবে।

০২. উভয়ই মহান আল্লাহকে যে ভালবাসবেন তা পরিষ্কার ভাবে দুজনা বোঝা পড়া করবেন।

০৩. হানিমুনে কোথায় যাবেন তা বাসর রাতেই ঠিক করবেন, সে ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীকে এটা ঠিক করতে হবে যে, সবচেয়ে পৃথিবীর মূল্যবান যায়গা মক্কা মদীনায় যাওয়া এবং ওমরা করার পরিকল্পনা করা।

০৪. ছোট খাট ভুলের জন্য কাউকে তিরষ্কার না করা। কাউকে ছোট না করা।

০৫. কোন পক্ষের আত্নীয় স্বজনকে ছোট না করা, গালি না দেওয়া, অপমান না করা।

০৬. জীবনের প্রথম ভালবাসার রাত, তাই ভালবাসা অক্ষুন্ন রাখা।

০৭. দুজনাতে একটু খোশ গল্প করা, জীবন থেকে কোন গল্প বলা।

০৮. ভবিষ্যত জেনারেশনের ব্যাপারে আলাপ সেরে নেওয়া। তবে বেশী দূর অগ্রসর না হওয়াই ভাল।

০৯. মোহরানা যদি বাকি থাকে সেটা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া, অল্প দিনের মধ্যেই মোহরানা পরিশোধ করা। স্ত্রী যদি চাকুরি করে তবে টাইম টেবিলটা নিয়ে একটু পরিষ্কার

১০. এ রাতই হল উত্তম ভালবাসার রাত। দুজনার সব আকুতি মেশানো ভালবাসা দিয়ে দুজনাকে জয় করা। কোন ভাবেই যেন ফজরের নামাজ কাজা না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা ।

ইসলামে নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিয়েই হচ্ছে একমাত্র বৈধ উপায়। বিয়েতে মোহরানা ধার্য করা এবং তা যথারীতি আদায় করার জন্য ইসলামে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে মোহরানা প্রদান করা ফরজ।

কোরআন ও হাদীসের আলোকে মোহরানা :

মোহরানা সম্পর্কে কোরআনের বানী :

আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের নিকট যে যৌন স্বাধ গ্রহন কর, তার বিনিময়ে তাদের মোহরানা ফরজ মনে করে আদায় কর।’ (সূরা নিসা-২৪)

আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘অতঃপর নারীদের অভিভাবকের অনুমুতি নিয়ে তাদের বিয়ে কর এবং তাদের মোহর যথাযথভাবে আদায় করে দাও।’ (সূরা নিসা-২৫)

আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“স্ত্রীদের প্রাপ্য মোহরানা আদায় করে দাও, খূশী হয়ে ও তাদের প্রাপ্য অধিকার মনে করে।’ (সূরা নিসা-৪)

অত্র আয়াত সমুহ প্রমাণ করে যে, মোহরানা ফরজ বা আদায় করা অপরিহার্য।

মোহরানা সম্পর্কে রাসুল (সাঃ) এর বানী :

উক্ববা ইবনু আমের (রাঃ) বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “অবশ্যই পূরণীয় শর্ত হচ্ছে, যার বিনিময়ে তোমরা স্ত্রীর যৌনাঙ্গ নিজেদের জন্য হালাল মনে কর।’ (বুখারী,মুসলিম)

মহানবী (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন মেয়েকে মোহরানা দেয়ার ওয়াদায় বিয়ে করেছে, কিন্তু সে মোহরানা আদায় করার তার ইচ্ছে নেই, সে কেয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে অপরাধী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।’ (মুসনাদে আহমেদ)।

সুতরাং মোহরানা স্ত্রীর এমন একটি প্রাপ্য যা তিনি স্বামীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে পাওনা হন, তবে স্ত্রী (স্বেচ্ছায় ও স্বত:স্ফূর্তভাবে) সময় দিলে বাকি রাখা যাবে। কিন্তু মোহরানার অর্থ আবশ্যিকভাবে পরিশোধ করতে হবে। বিবাহিত স্ত্রীকে অসহায় মনে করে ছলে-বলে-কৌশলে বা অজ্ঞতার সুযোগে মাফ করিয়ে নিলে মাফ না হয়ে তা হবে জুলুম-প্রতারণা। এ জুলুম প্রতিরোধকল্পে মহান আল্লাহপাক ঘোষণা করেন – ‘যদি স্ত্রী নিজের পক্ষ থেকে স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে মোহরের কিছু অংশ ক্ষমা করে দেয়, তবে তোমরা তা হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করতে পার।’ (সূরা নিসা, আয়াত-৪)।

মোহরানা এককালীন আদায় করতে অক্ষম হলে, উত্তম হল কিছু অংশ নগদ আদায় করে বাকি অংশ পরে আদায় করা, তা ধীরে ধীরে কিস্তিতে পরিশোধ করা। তবে মোহরানা নির্ধারণ করতে হবে স্বামীর সামর্থ্য অনুযায়ী যাতে তিনি সহজেই তা পরিশোধ করতে পারেন। কিন্তু বর্তমান সমাজের দু:খজনক ঘটনা হলো-বিশাল আকারের মোহরানা বাধা হয় নামে মাত্র অথচ বহুলাংশে তা পরিশোধ করতে দেখা যায় না।

আমাদের সমাজে কি দেখতে পাচ্ছি ?

আজ থেকে ২০/২৫ বছর আগেও বিয়েতে অল্প পরিমান মোহরানা ধার্য করা হতো। স্ত্রীকে প্রদান করতো কিনা আমার জানা নেই। তবে বর্তমানে বিয়েতে বেশী পরিমানে মোহরানা ধার্য করা হচ্ছে তার অন্যতম কারন হচ্ছে –

বিবাহ বিচ্ছেদ দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই মোহরানা বেশী ধার্য করা হয় যাতে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিতে ভয় পায়।

মিথ্যা ওয়াদা দিয়েই নব-দম্পর্তির সংসার জীবন শুরু হয় :

স্ত্রীকে মোহরানা আদায় করা ফরজ। আর এই ফরজ কাজটি না করে কিভাবে সংসার জীবন শুরু করবে? তাই বিয়ের পর স্ত্রীর সাথে প্রথম সাক্ষাতেই এই বিষয়টি ফয়সালা করা হয়। বউকে পরবর্তীতে প্রদান করার ঘোষনা দিয়েই সংসার জীবন শুরু করতে হয়। অচত আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের নিকট যে যৌন স্বাধ গ্রহন কর, তার বিনিময়ে তাদের মোহরানা ফরজ মনে করে আদায় কর।’ তারপর মোহরানা আদায় না করে বছরের পর বছর স্ত্রীর সাথে বসবাস করে। স্ত্রীও সংসারের সুখ-শান্তি নষ্ট হবার ভয়ে স্বামীর কাছে মোহরানা অর্থ চাইতে সংকোচ করে। অনেকে স্বামী মোহরানার অর্থ আদায় না করেই কোন এক সময় না ফেরার দেশে চলে যায়। অনেকে সংসারে অশান্তি দেখা দিলে তালাকের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘঁটান আর তখনই স্বামীকে আদালতের রায়ের মাধ্যমে মোহরানার অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়।

আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশকে অমান্য করে আজ আমরা বিয়েতে মোহরানা কে কত বেশী দিতে পারি, কে কত নিতে পারি সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছি। যার ফলে সংসারে অশান্তি,ভূল-বোঝাবুঝি, পরিশেষে বিচ্ছেদের মত ঘঁটনা ঘটে।

তাই সবাইকে বলছি, বিয়েতে সমতা রক্ষা করুন। কম মোহরানা ধার্য করুন। আর মোহরানা আদায় করেই সংসার জীবন শরুন। মনে রাখবেন, পরবর্তীতে প্রদান করার মিথ্যা প্রতিশ্র“তি দিয়ে সংসার শুরু করলেও যে কোন মুহুত্বে আপনার মৃত্যু হতে পারে। তখন আপনার স্ত্রী কার কাছে মোহরানা চাইবে? যদি মোহরানা আদায় করার মত কিছু না থাকে? স্ত্রীর মোহরানা আদায় না করে আপনি কি জান্নাতে যেতে পারবেন?

তাই কেবল সামাজিক স্টাটাস রক্ষার জন্য মোটা অংকের মোহরানা নয়; বরং সামর্থ্যরে মধ্যে মোহরানা বেঁধে নির্দিষ্ট সময়ে বাসর হওয়ার আগেই তা পরিশোধ করে দেয়া উচিত।

কাহিনীঃ জাফর তানিয়াকে ১৬ লাখ টাকা মোহরানা ধার্য করে বিয়ে করেছে। বিয়েতে জাফর তানিয়াকে দশ ভরি স্বর্ণ উপহার দেয়। দুই পরিবারের সম্মতিতে স্বর্নের মূল্য থেকে তিন লাখ টাকা উসুল দেখিয়ে বাকী টাকা পরে পরিশোধ করার অঙ্গীকার করে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পরে বাসর রাতে জাফরের ভাবী রুমে প্রবেশ করে মোহরানার বাকী টাকাটা কিভাবে পরিশোধ করবে জাফরের কাছে জানতে চায়। জাফর পরবর্তীতে পরিশোধ করবে বলে ভাবীর সামনে তানিয়াকে জানায়। তানিয়া এই প্রস্তাবে রাজী হয়ে জাফরকে নিয়ে স্বপ্নের বাসর রাত পার করে।

বাসর রাতে বিড়াল মারা নিয়ে বিবাহিত/অবিবাহিত নারী/পুরুষরা নানা গুঞ্জন করে থাকে। একেক একজন একেক দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখে। সবাই এই বিষয়টিকে নিয়ে হাসি-তামাশা করে। বিড়াল মারতে পারলে সবাই খুশী। তবে দুঃখ জনক হলেও সত্য যে আজকাল স্বামীরা বাসর রাতে বিড়াল মারা তো দুরের কথা উল্টো বউয়ের কাছে মাফ চাইতে হয়। কেন মাফ চাইতে হয় জানেন? তাহলে শুনুন।

আজ থেকে কয়েক দশক আগেও বিয়েতে খুব অল্প পরিমান মোহরানা ধার্য করা হত। বেশীর ভাগ স্বামী মোহরানা আদায় করে দিত। কেউবা বউয়ের নামে জমি লিখে দিত। কিন্তু আজকাল মোহরানা নিয়ে বর-কনে দু’পক্ষের মধ্যে দর কষাকষি শুরু হয়।

ডিজিটাল এই যুগে তালাকের পরিমান দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই তালাক ঠেকাতে এখন মোহরানার পরিমান বেশী ধার্য করা হয়। মোহরানার টাকা স্বামী স্ত্রীকে দিতে পারবে কি পারবে না তা আর কেউ দেখে না। এখন বেশী টাকা মোহরানা ধার্য করে বিয়ে ঠিকিয়ে রাখার জন্য সবাই চেষ্টা করে। স্বামীকে চাপের মধ্যে রাখে। এই সুযোগে স্ত্রীদের পক্ষ থেকে তালাকের প্রস্তাব বেশী আসছে। তাই তালাকের পরিমান দিন দিন বেড়েই চলেছে।

ইসলামে মোহরানা আদায় করে স্ত্রীর কাছে যেতে বলা হয়েছে। বর্তমানে বিয়েতে স্ত্রীকে উপহার দেয়া স্বর্নের মূল্য হিসাব করে কিছু টাকা উসুল দেখিয়ে মোহরানার বাকী টাকাটা বাকীর খাতায় রেখে দেয়া হয়। তাই মোহরানার টাকা শত ভাগ পরিশোধ না করে বাসর রাতে স্বামী স্ত্রীকে মোহরানার বাকী টাকা পরে পরিশোধ করার ওয়াদা করে থাকে। স্ত্রীও স্বামীর কথায় বিশ্বাস করে সংসার জীবন শুরু করে। তাই বাসর রাতে বিড়াল মারার পরিবর্তে উল্টো স্ত্রীর কাছে মোহরানার টাকা নিয়ে ছোট হতে হয়।

দাম্পত্য জীবনে কোন এক সময় ভুল-বুঝাবুঝি হলে তালাকের মাধ্যমে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইলে স্বামী স্ত্রীকে মোহরানার টাকা পরিশোধ করতে হয়। মোহরানার টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে স্বামী জেলের ভাত খেতে হয়।

তাই বাসর রাতে বিড়াল মারা নিয়ে যারা অতি উৎসাহী তাদেরকে বলতে চাই, বাসর রাতে বিড়াল মারার আগে স্ত্রীর মোহরানা আদায় করুন। মোহরানা আদায় না করে যদি আপনার মৃত্যু হয় তাহলে আপনাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে –

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বাসর রাতে স্বামী-স্ত্রীর করণীয় কি পড়ে দেখুনঃ

বাসরঘর ও কনে সাজানো এবং তাদের জন্য দোয়া করাঃ

নতুন বর ও কনের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, যেখানে সুন্দরভাবে সাজিয়ে সুসজ্জিত করে বরের নিকট পেশ করা হবে। যেসব মহিলারা কনেকে সাজাবে তারা তাদের (বর-কনে) জন্য কল্যাণ, বরকত ও সৌভাগ্যবান হওয়ার জন্য দোয়া করবে।

বর-কনের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করা এবং কনেকে সাজানো সুন্নত। আসমা বিনতে ইযাযিদ (রাঃ) বলেন, আমি রাসুল (সাঃ) এর জন্য আয়েশাকে সুসজ্জিত করেছিলাম।

:- আলআমীন

Image may contain: 1 person, sitting

এই কাজগুলো করলে জীবনেও অভাব দূর হবে না



দুনিয়াতে অনেক মানুষ আছে যারা আল্লাহর হুকুম আহকাম পালনের ক্ষেত্রে অলসতা বা দে রি করে বা তা করার সময় হয়নি কিংবা পরে করবে বলে রেখে দেয়। এ সব বিষয়ে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে সতর্ক করেছেন।

আল্লাহ তাআলা ইবাদত-বন্দেগি ও তার বিধি-বিধান পালনে আগ্রহী ও অলসতাকারীদের জন্য সুসংবাদ ও কঠোরতা প্রকাশ করেছেন। হাদিসে কুদসিতে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এমন একটি ঘোষণাই এসেছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

‘হে আদম সন্তান! আমার ইবাদতের জন্য তুমি নিজের অবসর সময় তৈরি কর ও ইবাদতে মন দাও; তাহলে আমি তোমার অন্তরকে প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দেব এবং তোমার দারিদ্র্য ঘুচিয়ে দেব।

আর যদি তা না কর; তবে-

তোমার হাতকে ব্যস্ততায় ভরে দেব এবং তোমার অভাব কখনোই দূর হবে না।’ (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)

উল্লেখিত হাদিসের ঘোষণা অনুযায়ী যারা ইবাদত-বন্দেগিসহ যাবতীয় বিধি-বিধান পালনে নিজেকে তৈরি করবে; তাদের অন্তরকে আল্লাহ তাআলঅ প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দেবেন এবং তাদের অভাব-অনটন দূর করে দিবেন।

পক্ষান্তরে যারা নামাজ, রোজা, হজ, যাকাতসহ যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগিসহ আল্লাহর বিধি-বিধান পালনে ব্যস্ততা দেখাবে; বা সময় হয় না বলে ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদেরকে পিছিয়ে রাখবে; তাদেরকে আল্লাহ তাআলা সব সময়ই ব্যস্ততায় রাখবেন এবং কখনোই তাদের অভাব দূর হবে না।

সুতরাং ইবাদত-বন্দেগিতে ব্যস্ততা বা তাড়াহুড়ো বা অলসেমি নয় বরং সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্দেষিত ও নির্ধাররিত ইবাদত যথাযথ পালন করে দুনিয়ার স্বচ্ছলতা ও স্বচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন লাভের পাশাপাশি পরকালের সফলতা লাভ করা জরুরি।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দুনিয়ার জীবনে ইবাদত-বন্দেগি ও বিধি-বিধান পালনের মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বচ্ছলতা লাভ করার তাওফিক দান করুন। অবহেলা আলসেমি থেকে নিজেকে বিরত রেখে দুনিয়ার অভাব ও ব্যস্ততা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

সুত্রঃ পিএনএস

মুহাম্মদ (সা.) এর চিকিৎসার মূল্যবান তথ্য!

পিএনএস, ইসলাম : মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) চিকিৎসক ছিলেন না। কিন্তু নবীজী (সা.) ১৪০০ বছর আগে উম্মতের মানসিক ও দৈহিক রোগ ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেসব মূল্যবান তথ্য প্রদান করে গেছেন, তা যুগে যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য একটা সুস্পষ্ট পথ পদর্শক। ‘তিব্বে নববী’ গ্রন্থটির আলোকে মহানবী সাঃ-এর চিকিৎসা বিধানের সামান্য কিছু তথ্য তুলে ধরা হলোঃ


নবী করিম (সা.) নামাজকে আরোগ্যদানকারী হিসেবে অভিহিত করেছেন। উনার কথাটির বিশ্লেষণে যাওয়া যাক¬, সুস্থ দেহ ও মনের জন্য একান্ত জরুরি বিষয় হচ্ছে ব্যায়াম। যা নামাজের মাধ্যমেই উত্তমভাবে পালন করা যায়। লক্ষ করুন, যদি আমরা শুদ্ধ নিয়মে নামাজ আদায় করি তাহলে আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গেরই মুভমেন্ট হয়। ফলে রক্তসঞ্চালনও সুন্দরভাবে চলতে থাকে। যেমন¬ সেজদা অবস্থায় হাত, পা, পেট, পিঠ, কোমর, রান ও শরীরের সব অঙ্গের জোড়া টানটান অবস্থায় থাকে। এ সময় রক্ত মস্তিষ্ক পর্যন্ত সঞ্চালিত হয়। আর সেজদা অবস্থায় মহিলাদের বুক রানের সাথে মিশে থাকে। এতে তাদের অভ্যন্তরীণ রোগ ব্যাধির উপশম হয়। অর্থাৎ নামাজ আত্মিক উন্নতির পাশাপাশি দৈহিক সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


হাদিস শরিফে বিভিন্ন রোগ ও প্রতিষেধকেরও উল্লেখ আছে। যেমন¬ নবীজী মেহেদিকে মাথাব্যথার প্রতিষেধক বলেছেন। তিনি এটাকে ফোঁড়া পাকায় এবং কাঁটা বিধলেও ব্যবহার করতেন। সূরা নাহলে মধুকে শেফাদানকারী ঘোষণা করা হয়েছে। আর নবীজীরও নির্দেশ, ‘যে ব্যক্তি প্রতি মাসে তিন দিন সকাল বেলায় মধু সেবন করবে তার কোনো কঠিন ব্যাধি হবে না।’

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান আজ এটাই প্রমাণ করেছে, মধু অগণিত রোগের ওষুধ এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন। তবে হ্যাঁ, মধু কোন রোগে কতটুকু ব্যবহার প্রয়োজন সে বিষয়ে গবেষণা করার দায়িত্ব চিকিৎসকদেরই। হাদিসে কালোজিরা ও সিনাকে সর্বরোগের ওষুধ বলা হয়েছে। সিনা মস্তিষ্ক পরিষ্কার, বেদনানাশক, কৃমিনাশক, মাথাব্যথানাশক, গিঁটবাত ও নিউমোনিয়া রোগে উপকারী। অপর দিকে কালোজিরা বিভিন্ন ঠাণ্ডাজাতীয় ব্যাধির ওষুধ ছাড়াও যকৃৎ, পাকস্থলী, মূত্রাশয়ের শক্তিবর্ধক।

মহানবী সাঃ বলেছেন, ‘যখন রোগ যন্ত্রণা খুব কষ্টদায়ক হয় তখন এক চিমটি কালোজিরা, অতঃপর পানি ও মধু সেবন করবে।’ এ ছাড়াও ঘৃতকুমারী ত্বকের লাবণ্যতায়, যাইতুন নিউমোনিয়ায়, আগরকাঠ গলগণ্ডে, চিরতা ফোঁড়ার সমস্যায়, খেজুর ও বিহিদানা হৃদরোগে, যব পেট ব্যথায়, সুরমা দৃষ্টিশক্তিতে, বিলাতি ডুমুর অর্শ ও গেটে বাতে, ঠাণ্ডা পানি জ্বরে, লবণ হজম শক্তিতে ব্যবহারের নির্দেশ হাদিসে উল্লেখ আছে। হাদিস ও ইতিহাস বিশ্লেষকদের মতে নবীজীর প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল তরমুজ, মধু, লাউ, দুধ, যাইতুন, খেজুর, ভুনা গোশত, পাখির গোশত, মাছ আর তিনি অত্যধিক গরম ও বাসি খাবার এড়িয়ে চলতেন। তিন দুধ ও মাছ যেমন কখনো একসঙ্গে খেতেন না, তেমনি দু’টি গরম, দু’টি ঠাণ্ডা, নরম বা আঠালো জিনিসও একসাথে খেতেন না। নবীজী আমাদের ক্ষুধার সাথে সামঞ্জস্যশীল এবং পরিমিত আহারেরও পরামর্শ দিয়েছেন।

সুত্রঃ পিএনএ

মঙ্গলবার, ১৭ জুলাই, ২০১৮

বউ-শাশুরীর সম্পর্কগুলো এরকম মধুর হলে কোন পরিবারেই অশান্তি থাকতো না।

ফজর নামাজে অভ্যস্ত করতে পারি নি।
তুমি এক মাসেই পেরেছ!
→আম্মু, আপনি কি পাথর আর স্বর্ণের গল্পটা
জানেন?
→না তো!
→কোন এক গ্রামে চলাচলের পথে একটি
বড় পাথর প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল।এক
ব্যক্তি রাস্তা পরিস্কার করতে মনস্থ
করল।সে একটি কুড়াল নিয়ে পাথরটি
ভাঙার চেষ্টা করল। ৯৯টি আঘাত করে সে
ক্লান্ত হয়ে গেল। তখনই সেখান দিয়ে এক
পথিক যাচ্ছিল। লোকটি পথিকের সাহায্য
চাইলো। পথিক কুড়াল নিয়ে আঘাত
করতেই পাথরটি ভেঙে গেল এবং ভেতর
থেকে স্বর্ণভর্তি একটি থলে বেরিয়ে
এল।
-পথিক: যেহেতু পাথরটি আমার আঘাতে
ভেঙেছে তাই থলেটি আমার।
-আমাকেও কিছু দাও।আমিও যে ৯৯টি
আঘাত করলাম।
পথিক রাজি হল না। দুজনে কাজীর কাছে
গেল। সব শোনে কাজী মীমাংসা
করলেন। স্বর্ণগুলোকে ১০০ভাগ করে ১ভাগ
দিলেন পথিককে বাকি ৯৯ভাগ
লোকটিকে দিয়ে দিলেন। বললেন,' "যদি
তোমার ৯৯টি আঘাত না হত তাহলে এই
পাথরটি ভাঙতোই না"।
-আম্মু,আপনি ২৮টি বছর পরিশ্রম করে সবকিছু
প্রস্তুত করেছেন। আমি শুধু শেষ আঘাতটাই
করেছি।
বউ-শাশুরীর সম্পর্কগুলো এরকম মধুর হলে
কোন পরিবারেই অশান্তি থাকতো না।

সোমবার, ১৬ জুলাই, ২০১৮

পছন্দের মানুষকে বিয়ে করার জন্য বিশেষ আমল

এখন যেই আমল লিখছি, তা শুধু বিয়ের উদ্দেশ্যেই করা যাবে, এমন না। বরং এই আমলটি যেকোনো প্রয়োজন পূরণের জন্য করলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ তায়ালা।
এই আমলের কয়েকটি শর্ত রয়েছে। শর্তগুলো অবশ্যই সঠিকভাবে পালন করতে হবে।
তা হল,
১: পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে।
২: মিথ্যা বলা ও হারাম খাদ্য খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩: মানুষকে ধোকা দেওয়া যাবেনা।
৪: সাধ্যমতো গরিবদের দান করতে হবে। এবং সুযোগ হলে মানুষের উপকার করতে হবে।এবং আল্লাহকে খুশি করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নেক আমল করার চেষ্টা করবে।
৫: বিশেষত যারা পছন্দের মানুষকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে এই আমল করবে, তারা সব ধরনের গুনাহ ছেড়ে তওবা করবে এবং ভবিষ্যতে গুনাহ না করার মন মানসিকতা তৈরি করবে।
৬: আর বিশেষত যাকে ভালবাসেন, তার জন্য, নিজের ও তার পরিবার এবং আগে ও পরের সকল মুসলমানদের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে মাফ চাইবেন। এই ৬ নং শর্তটা দারুন ফলপ্রদ।
উপরের শর্তগুলো ঠিকমতো পালন করতে পারলে, আশা করা যায় যে, আপনার উদ্দেশ্য যত বড়ই হোক না কেন, ইনশাআল্লাহ তায়ালা আপনার উদ্দেশ্য আল্লাহ তায়ালা পূরন করে দিবেন।
অতঃপর যেকোন দিন মাগরিবের নামাজ আদায় করে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করবে। যার যে প্রয়োজন, সেই উদ্দেশ্য পূরনের নিয়তে নামাজ পড়বে। এবং নামাজ শেষে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে আকুতি মিনতি করে বিনয়ের সহিত নিজের উদ্দেশ্য পূরনের জন্য দোয়া করবে। কেঁদে কেঁদে দোয়া করার চেষ্টা করবে। কারন মহান আল্লাহ তায়ালা কান্না করে দোয়া করলে অনেজ খুশি হোন। আর আল্লাহ তায়ালা খুশি হলে "কেল্লা ফতেহ"। আর কেউ কাঁদতে না পারলে, কান্না করার ভান করবে,, এতেও আল্লাহ তায়ালা খুশি হোন।
অতঃপর দোয়া শেষে পশ্চিম মুখ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর অফুরন্ত রহমতের উপর ভরসা করে ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত মহান আল্লাহ তায়ালার এই নাম খুব ভালবেসে ডাকতে থাকবে। প্রেমিক যেমন তার ভালবাসার মানুষকে আদর করে অনেক আবেগ নিয়ে ডাকে, ঠিক তেমনি আল্লাহ তায়ালাকে মহব্বতের সহিত ডাকতে থাকবেন।
يَا رَبِّ
"ইয়া রব্বি"
অর্থ, হে আমার পালনকর্তা!
আর ডাকার সময় মনে মনে ভাববেন যে, আপনি আল্লাহকে অনেক ভালবাসেন। আর আল্লাহ তায়ালা আপনাকে আরো অনেক বেশি ভালবাসেন। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা আপনি যা চাইবেন, তাই খুশি হয়ে দান করবেন।
আমল শেষ করার পর মুনাজাত করবেন। মুনাজাতে ১ বার সুরা ফাতেহার প্রথম আয়াত পড়বেন এবং ১ বার নবিজি সাঃ এর উপর যেকোন একটি দুরুদ শরিফ পড়বেন। অতঃপর নিজের বাসনা পূরনের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করবেন।
এভাবে মাগরিবের পরে লাগাতার ৭ দিন আমল করবেন। এবং ৭ দিন শেষ হওয়ার পর প্রতি বৃহস্পতিবার মাগরিবের পরে ২ রাকাত নফল নামাজ পড়ে একই আমল করবেন। কোন কারণে বৃহস্পতিবারে করতে না পারলে শুক্রবার মাগরিবের পর করে নিবেন।
কখনো মহান আল্লাহ তায়ালার উপর থেকে ভরসা ত্যাগ করবেন না। বিরামহীনভাবে আমল চালাতেই থাকবেন। বিশেষত যারা পছন্দের মানুষকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে আমল করবেন। এভাবে আমল চালাতে থাকলে ইনশাআল্লাহ তায়ালা কয়েকমাসের মধ্যেই বিয়ের ভাল ব্যবস্থা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ তায়ালা। আল্লাহ চাইলে ১/২ মাসেও হতে পারে। আর না হলে নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমল যত বেশি হবে, আপনার জন্য ততো ভাল।
আর দোয়া করার সময় বিবাহের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়েও দোয়া করতে পারেন। অর্থাৎ আপনার ভালবাসার মানুষ যেন আপনাকে অনেক ভালবাসে, আপনাকে ছাড়া অন্য কারো দিকে না তাকায়। বিয়ের পর দাম্পত্যজীবনে যাতে মহান আল্লাহ তায়ালা রহমত ও বরকত দান করেন। আপনার পছন্দের মানুষ যেন, আপনার হক পুরোপুরিভাবে আদায় করে। অভাব - অনটন যাতে না হয়, ইত্যাদি দোয়া করবেন। সুতরাং আমল যত বেশি সময় নিয়ে করবেন এবং দীর্ঘদিন করবেন, আপনার দোয়ার বরকতে ততো বেশি কল্যাণ আল্লাহ পাক দান করবেন ইনশাআল্লাহ তায়ালা।
সুতরাং কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ হতে দেরী হলেও হতাশার কোন কারণ নেই। অনেক সময় আল্লাহ তায়ালা বান্দার ভালোর জন্যই দোয়া কবুল করতে দেরি করেন।অতএব আমাদের ধৈর্য ধরে আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা করে আমল চালাতে থাকা উচিৎ। আরর এতে আল্লাহ তায়ালাও অনেক খুশি হন, এর প্রমাণ পবিত্র কোরআনেও আছে।
পবিত্র কোরআনে মহান রব্বুল আ'লামীন বলেন,
يا ايه الذين امنوا استعينوا بالصبر والصلوۃ. ان الله مع الصبرين
সুরা বাকারা। আয়াত ১৫৩.
অর্থাৎ হে মুমিনগন! তোমরা নামাজ ও ধৈর্যধারণের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কাছে সাহায্য চাও। নিশ্চয় ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ আছেন।
সুতরাং এতেই প্রমাণ হয় যে, ধৈর্যধারণ করলে কত বেশি সুফল পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ তায়ালা।
আপনারা যাতে ভাল ফলাফল লাভ করতে পারেন, এজন্যইই এতো দীর্ঘ আলোচনা করলাম। প্রথমে ধারাবাহিক ৪১ দিনের আমল দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম, কিন্তু অনেকের জন্য তা কষ্টকর হয়ে যেতে পারে, তাই ৭ দিনের আমল দিলাম।
এই আমল পাকিস্তনের দুইজন ভাল উস্তাদ থেকে পেয়েছি, আর আমিও কয়েকটি প্রয়োজন পূরনের উদ্দেশ্যে এর উপর আমল করে মহান আল্লাহ তায়ালার রহমতে ধারনার চেয়েও বেশি সুফল লাভ করেছি।
তো আপনার সবাইকে এই আমল গিফট হিসেবে পোস্ট করলাম। ইনশাআল্লাহ তায়ালা এর উপর আমল করলে কেউ নিরাশ হবে না।
যারা করবেন, তারা কমেন্ট করে অনুমতি নিয়ে নিবেন। দরকার হলে ইনবক্স করবেন
মহান আল্লাহ তায়ালা সবাইকে সফলতা দান করুন। আমিন।

শনিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৮

ইস্তেখারা বা কোন বিষয়ে আল্লাহতালার নিকট কল্যাণ চাওয়া।(ইস্তেখারা করার পদ্ধতী)

ইস্তেখারা শব্দের অর্থ :
ইস্তেখারা শব্দটি আরবী। আভিধানিক অর্থ, কোন কোন বিষয়ে কল্যাণ চাওয়া।

ইসলামী পরিভাষায় :
দুই রাকাত সালাত ও বিশেষ দুয়ার মাধ্যমে আল্লাহর তায়ালার নিকট পছন্দনীয় বিষয়ে মন ধাবিত হওয়ার জন্য আশা করা। অর্থাৎ দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনটি অধিক কল্যাণকর হবে এ ব্যাপারে আল্লাহর নিকট দু রাকায়াত সালাত ও ইস্তিখারার দুয়ার মাধ্যমে সাহায্য চাওয়ার নামই ইস্তেখারা।

[ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারী]

ইস্তেখারা করার হুকুম :
এটি সুন্নাত। যা সহীহ বুখারীর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
ইস্তিখারা কখন করতে হয়?
মানুষ বিভিন্ন সময় একাধিক বিষয়ের মধ্যে কোনটিকে গ্রহণ করবে সে ব্যাপারে দ্বিধা-দন্ধে পড়ে যায়। কারণ, কোথায় তার কল্যাণ নিহীত আছে সে ব্যাপারে কারো জ্ঞান নাই। তাই সঠিক সিদ্ধান্তে উপণিত হওয়ার জন্য আসমান জমীনের সৃষ্টিকর্তা, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত সকল বিষয়ে যার সম্যক জ্ঞান আছে, যার হাতে সকল ভাল-মন্দের চাবী-কাঠি সেই মহান আল্লাহর তায়ালার নিকট উক্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়। যেন তিনি তার মনের সিদ্ধান্তকে এমন জিনিসের উপর স্থীর করে দেন যা তার জন্য উপকারী। যার ফলে তাকে পরবর্তীতে আফসোস করতে না হয়।

যেমন: বিয়ে, চাকরী, সফর ইত্যাদি বিষয়ে ইস্তেখারা করতে হয়।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন:
“সে ব্যক্তি অনুতপ্ত হবে না যে স্রষ্টার নিকট ইস্তিখারা করে এবং মানুষের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার উপর অটল থাকে।”

আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“আর তুমি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মানুষের সাথে পরমর্শ কর। অত:পর আল্লাহর উপর ভরসা করে (সিদ্ধান্তে অটল থাক)। আল্লাহ ভরসাকারীদেরকে পছন্দ করেন।“

[সূরা আলে ইমরান: ১৫৯]

কাতাদা(রহঃ) বলেন:
“মানুষ যখন আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরষ্পরে পরামর্শ করে তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সব চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার তওফীক দেন।”

ইমাম নওবী রহ. বলেন:
“আল্লাহ তায়ালার নিকট ইস্তেখারা করার পাশাপাশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ভাল লোকদের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। কারণ, মানুষের জ্ঞান-গরীমা অপূর্ণ। সৃষ্টিগতভাবে সে দূর্বল। তাই যখন তার সামনে একাধিক বিষয় উপস্থিত হয় তখন কি করবে না করবে, বা কি সিদ্ধান্ত নিবে তাতে দ্বিধায় পড়ে যায়।”
ইস্তিখারা করার নিয়ম:

১) সালাতের ওযুর মত করে ওযু করতে হয়।

২) ইস্তিখারার উদ্দেশ্যে দু রাকায়াত সালাত পড়তে হয়। এ ক্ষেত্রে সুন্নত হল, প্রথম রাকায়াতে সূরা ফাতিহার পর কুল আইয়োহাল কাফিরূন এবং দ্বিতীয় রাকায়াতে সূরা ফাতিহার পর কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ পড়া।

৩) নামাযের সালাম ফিরিয়ে অথবা সালাম ফিরানোর ঠিক পূর্বমুহুর্তে আল্লাহ তায়ালা বড়ত্ব, ও মর্যাদার কথা মনে জাগ্রত করে একান্ত বিনয় ও নম্রতা সহকারে আল্লাহর প্রশংসা ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর দুরূদ পেশ করার পর নিচের দুয়াটি পাঠ করা:


اللَّهُمَّ إنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ , وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ , وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلا أَقْدِرُ , وَتَعْلَمُ وَلا أَعْلَمُ , وَأَنْتَ عَلامُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ (………) خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي) أَوْقَالَ : عَاجِلِأَمْرِيوَآجِلِهِ) فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ , اللَّهُمَّ وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ(……...) شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي (أَوْقَالَ : عَاجِلِأَمْرِيوَآجِلِهِ) فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدُرْ لِي الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ ارْضِنِي بِهِ (……).

হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) প্রত্যেক কাজে আমাদের ইস্তিখারা করা সম্পর্কে এমন ভাবে শিক্ষা দিতেন যেভাবে কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, তোমাদের কেউ যখন কোন কাজ করার করবে তখন সে দুরাকাত নফল নামাজ আদায় করবে, এরপর সে পাঠ করবে:

–আল্লাহুম্মা ইন্নী আস্তাখিরুকা বি ইলমিকা
ওয়া আস্তাকদিরুকা বি কুদরাতিকা
ওয়া আসআলুকা মিনফাদ্বলিকাল আযীম,
ফা ইন্নাকা তাকদিরু ওয়ালা আকদিরু,
ওয়া তা’লামু ওয়ালা আ’লামু
ওয়া আন্তা আল্লামুল গুয়ূব।
আল্লাহুম্মা ইনকুন্তা তা’লামু
আন্না হাযালআমরা (এখানে নিজের কাজের কথা উল্লেখ করবেন)
খাইরুল্লি ফি দ্বীনী ওয়া মাআশীয়ী
ওয়া আক্বিবাতি আমরী
(অথবা বলবে: আ’ জিলি আমরি ওয়া আজিলিহি)
ফাকদিরহু লি ওয়া ইয়াসসিরহু লী
সুম্মা বারিকলী ফিহি
ওয়া ইন কুনতা তা’লামু
আন্না হাযাল আমরা (এখানে নিজের কাজের কথা উল্লেখ করবেন)
শাররুল্লী ফী দীনী ওয়া মাআশীয়ী
ওয়াআক্বিবাতি আমরী
(অথবা বলবে: আ জিলি আমরী ওয়া আজিলীহি)
ফাসরিফহু আন্নিওয়াসরীফনি আনহু
ওয়াকদির লিয়াল খাইরা হাইসু কানা
সুম্মা আরদ্বিনী বিহি।
দু'আর অর্থ এমন:

হে আ্ল্লাহ, আমি আপনার কাছে কল্যাণ চাই –আপনার ইলমের সাহায্যে।
আপনার কাছে শক্তি কামনা করি আপনার কুদরতের সাহায্যে।
আপনার কাছে অনুগ্রহ চাই আপনার মহা অনুগ্রহ থেকে।
আপনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী –আমার কোন ক্ষমতা নাই।
আপনি সর্বজ্ঞ – আমি কিছুই জানি না।
আপনি সকল গোপন বিষয় পূর্ণ অবগত।

“হে আল্লাহ, আপনার ইলমে এ কাজ (এখানে নিজের উদ্দেশ্যপূর্ণ জিনিসের কথা উল্লেখ করবেন) আমার দ্বীন আমার জীবন-জীবিকা ও কর্মফলের দিক থেকে (বা তিনি নিম্নোক্ত শব্দগুলো বলেছিলেন –এ কাজ দুনিয়া ও আখিরাতের দিক থেকে ভাল হয়) তবে তা আমাকে করার শক্তি দান করুন।

পক্ষান্তরে আপনার ইলমে এ কাজ (এখানে নিজের উদ্দেশ্যপূর্ণ জিনিসের কথা উল্লেখ করবেন) যদি আমার দ্বীন আমার জীবন-জীবিকা ও কর্মফলের দিক থেকে (অথবা বলেছিলেন, দুনিয়া ও পরকালের দিক থেকে মন্দ হয়) তবে আমার ধ্যান-কল্পনা এ কাজ থেকে ফিরিয়ে নিন। তার খেয়াল আমার অন্তর থেকে দূরীভূত করে দিন।

আর আমার জন্যে যেখানেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে এর ফায়সালা করে দিন এবং আমাকে এরই উপর সন্তুষ্ট করে দিন । (এরপর নিজের প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করবেন।)

[বুখারী, ২য় খন্ড, হাদিস নং: ২৬৩ ]



শুক্রবার, ১৩ জুলাই, ২০১৮

সুস্থ থাকা অবস্থাই তুমি খারাপ অভ্যাসটি ছেড়ে দাও: মুফতি মেঙ্ক

news-image

মুফতি ইসমাইল মেনক

শিক্ষাবিদ ও দাঈ
একজন ব্যক্তির হার্টের স্পন্দন যখন বন্ধ হয়ে যায়, তিনি ব্যথা অনুভব করেন। তার আত্মীয়-স্বজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার যখন বলেন, আপনাকে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস বাদ দিতে হবে। তিনি নিশ্চিতভাবেই অভ্যাসটি ত্যাগ করবেন। কেন? ডাক্তার বলেছেন তাই।
কিন্তু, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা জন্য আমরা কয়জন প্রস্তুত এটা বলতে যে “ এখন থেকে এই খারাপ অভ্যাস বাদ”। কয়জন বলতে পারি?
আমরা কি একটা হার্ট অ্যাটাকের জন্য অপেক্ষা করছি, একটা খারাপ অভ্যাস বাদ দেয়ার জন্য? যখন আল্লাহ বলছেন, এটার জন্য অপেক্ষা করো না, আমি তোমাকে একটি সুস্থ শরীর দিয়েছি। সুস্থ থাকা অবস্থাই তুমি খারাপ অভ্যাসটি ছেড়ে দাও।
কিছু লোক আল্লাহর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা কখনোই তার ইবাদত করে না। তখন, আল্লাহ কি করেন? তিনি তাদেরকে একটু সহযোগিতা করেন। সেই সহযোগিতাটা কি?
তিনি তাদেরকে এমন অসুস্থ করে দেন যে ডাক্তার ও তাকে সাহায্য করতে পারে না। তখন তারা বলতে বাধ্য হয় যে ‘ইয়া আল্লাহ’
তারা আল্লাহর কাছে প্রথমবারের মত হাত তুলে এবং নামাজে আসে। মাশাআল্লাহ! এটা কাম্য নয়। আমরা সত্যি ভাগ্যবান যে আমরা আল্লাহর কাছে হাত তোলার আগেই মৃত্যুবরণ করিনি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে আল্লাহর কাছে হাত তোলার জন্য (খারাপ) কিছু হওয়ার আগ পর্যন্ত কি আমাদের অপেক্ষা করা উচিৎ?
আল্লাহ এই জন্যই কৃতজ্ঞ হতে বলেছেন এবং শয়তান আমাদেরকে কুমন্ত্রনা দেবার আগেই তার সম্পর্কে জানতে বলেছেন যাতে করে আমারা বুঝতে পারি যে শয়তান কিভাবে আমাদেরকে বিপথে নিয়ে যায়।
যারা সারা জীবন ব্যভিচার করেছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন তারা এটি করে কী অর্জন করতে পেরেছে? যারা সারা জীবন পাপ (প্রতারনা, চুরি, মদ্যপান … ইত্যাদি ) করে যাচ্ছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন তারা এটি করে কী অর্জন করতে পেরেছে?
তারা কি অর্জন করেছে? ক্ষণিকের আনন্দ- তাইতো? এখন আল্লাহ যদি আপনার সহায় হয়, তিনি আপনাকে এটি বলার সুযোগ দিবেন যে ‘ও আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করুন, আমি এ কাজ আর কখনোই করবো না’।
AddThis Sharing ButtonsShare 

নেক সন্তান লাভের দোয়া

news-image
সন্তান-সন্তুতি দানের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তা’আলার হাতে। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে যত চাহিদা ও আকর্ষণ দান করেছেন, তার মধ্যে সন্তান-সন্তুতির আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। সুতরাং প্রত্যেক মানুষের উচিত আল্লাহ তা’আলার নিকট নেক সন্তানের কামনা করা।

আর যাদের সন্তান হয় না। তাদের উচিত আল্লাহর শেখানো ভাষায় আল্লাহ তাআলার নিকট দুআ’ করা পাঠকদের জন্য আজ এমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দুয়া’ তুলে ধরা হলো:

দুয়া’র উৎস: হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম বার্ধক্য পর্যন্ত নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন আল্লাহ তাআলা ফলের মৌসুম ছাড়াই হজরত মারইয়াম আলাইহিস সালামকে ফল দান করে রিজিকের ব্যবস্থা করেন।

তখন তাঁর মনে সন্তানের জন্য সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল। তিনি সাহস পেলেন যে, আল্লাহ বৃদ্ধ দম্পতিকেও সন্তান দান করতে পারেন। তাই তিনি আল্লাহর দরবারে উক্ত দুআ’টি করেন। আর সন্তান হওয়ার জন্য দু’আ করা পয়গাম্বরগণের সুন্নাত।


দুয়াটি হলো :
নেক সন্তান লাভের দুআ’

উচ্চারণ : রাব্বি হাবলি মিল্লাদুনকা জুররিয়্যাতান ত্বাইয়্যিবাতান, ইন্নাকা সামিউ’দ দুআ’ই (সূরা আল-ইমরান : আয়াত ৩৮)

অর্থ : হে আমাদের প্রভু! আপনার নিকট থেকে আমাকে পূত-পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা কবুলকারী।

সুতরাং আমরা সন্তান-সন্তুতি কামনায় দুনিয়ার কোনো মানুষের কাছে সন্তান কামনা করব না। কোনো অবৈধ ও অনৈসলামিক উপায় অবলম্বন না করে আল্লাহ ওপর ভরসা করে উক্ত দুআ’টি নিয়মিত পাঠ করি। আল্লাহ আমাদের নেক সন্তান দান করবেন। আল্লাহ আমাদেরকে কুরআনের ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

সুখী দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে রাসুল সা.-এর ৮ হাদিস

news-image
দাম্পত্য জীবনে স্বামী স্ত্রীর মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলতেই থাকে। সম্পর্ক এই ভালো তো এই খারাপ। এই ভালো খারাপের মধ্যে জীবন কখনো উপভোগ্য হয়ে ওঠে আবার বিরক্তিও চলে আসে। এই সম্পর্ক যতক্ষণ ভালো থাকে ততক্ষণ মনে হয় দুনিয়াটা বেহেশত। কিন্তু সম্পর্ক খারাপ গেলেই ঘর বাহির সব নরক হয়ে ওঠে। তাই সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য স্বামী স্ত্রী দুজনকেই কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে।
রাসূল সা. এমন দম্পতিদের জন্য কিছু নির্দেশনা বয়ান করেছেন। যা মেনে চললে দাম্পত্য জীবন অনেকটাই ভালোবাসায় পূর্ণ হবে। আসবে অফুরন্ত শান্তি। ইসলাম স্বামীর জন্য স্ত্রী আর স্ত্রীর জন্য স্বামীকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। নিচে এ সম্পর্কিত রাসুল সা. এর ৮টি হাদিস উল্লেখ করা হল –
১। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বর্ণনা করেন, রাসুল সা. বলেন, গোটা দুনিয়াই সম্পদে পরিপূর্ণ। এর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম সম্পদ হলো পূর্ণবতী স্ত্রী। [মুসলিম]

২। হজরত আবু হুরাইয়া রা. বলেন, রাসুল সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তির চরিত্র ও আচরণ সবচাইতে উত্তম, ঈমাদের দৃষ্টিতে সে-ই পূর্ণাঙ্গ মুমিন। তোমাদের মধ্যে সেসব লোক উত্তম, যারা তাদের স্ত্রীদের কাছে উত্তম। [তিরমিযি]

৩। হজরত উম্মে সালামা রা. এর বর্ণনা মতে, রাসুলে রা. বলেন, কোন স্ত্রী লোক যদি এমন অবস্থায় মারা যায় যে, তার স্বামী তার ওপর সন্তুষ্ট, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [তিরমিযি]

৪। হজরত আবু হুরাইরা রা. বলেন, রাসুল সা. ইরশাদ করেন, কোনো ব্যক্তি যদি তার বিছানায় স্ত্রীকে ডাকে; কিন্তু স্ত্রী তাতে সাড়া না দেয়ায় স্বামী তার উপর অসস্তুষ্ট হয়ে রাত কাটায়, তাহলে ফেরেশতারা ভোর পর্যন্ত তার (স্ত্রী) প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকে। [বুখারী ও মুসলিম]

৫। হজরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, স্বামী বাড়িতে উপস্থিত থাকা অবস্থায় তার অনুমতি ছাড়া স্ত্রীর পক্ষে (নফল) রোজা রাখা বৈধ নয়। তার অনুমতি ছাড়া কোন ব্যক্তিকে তার ঘরে ঢোকার অনুমতি দেয়াও তার (স্ত্রীর) জন্য বৈধ নয়। [বুখারী ও মুসলিম]

৬. হজরম মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. -এর বর্ণনা মতে, রাসুলে আকরাম সা. ইরশাদ করেন, যখনই কোন নারী তার স্বামীকে দুনিয়াতে কষ্ট দিতে থাকে, তখনই (জান্নাতের) হুরদের মধ্যে তার সম্ভাব্য স্ত্রী বলে, (হে অভাগিনী!) তুমি তাকে কষ্ট দিওনা। আল্লাহ তোমায় ধ্বংস করুক ! তিনি তোমার কাছে একজন মেহমান। অচিরেই তিনি তোমাকে ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসবেন। [তিরমিযী]

৭. হজরত আবু হুরাইরা রা. বলেন, রাসুল সা.ইরশাদ করেন, কোনো ব্যক্তি যদি তার বিছানায় স্বীয় স্ত্রীকে ডাকে; কিন্তু স্ত্রী তাতে সাড়া না দেয়ায় স্বামী তার উপর অসস্তুষ্ট হয়ে রাত কাটায়, তাহলে ফেরেশতারা ভোর পর্যন্ত তার (স্ত্রী) প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকে। [বুখারী ও মুসলিম]

৮. হজরত উসামা ইবনে যায়েদ রা. বর্ণনা করেন, রাসুলে আকরাম [সা.] বলেন, আমার অনুপস্থিতে আমি পুরুষদের জন্য মেয়েদের চাইতে বেশী ক্ষতিকর ফিতনা (বিপর্যয়) আর রেখে যাইনি। [বুখারী ও মুসলিম]

দ্রুত বিয়ে করতে যে আমলটি করবেন

news-image

বিয়ে করা যুবক-যুবতীদের জন্য ক্ষেত্র ভেদে ফরজ আবার কখনো সুন্নত। কিন্তু দ্রুত বিয়ে করে নেয়াই ভালো। অনেকের বয়স অতিক্রম হয়ে যায়, তারপরও বিয়ে হয় না। তাদের জন্য নিম্নের আমলটি দেয়া হলো;

যেসব যুবক-যুবতীদের বিবাহের বয়স অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না, তাদের মধ্যে যুবকেরা ডান হাত দিয়ে বাম হাতের কব্জি চেপে ধরে এবং যুবতীরা বাম হাত দিয়ে দান হাতের কব্জি চেপে ধরে প্রত্যহ ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয়ের আগে ৪০ বার হিসাবে ৪০ দিন পর্যন্ত ইয়া ফাত্তাহু (الفتاح) অর্থ হে উন্মুক্তকারী বা প্রস্তুকারী পড়বেন।

ইয়া ফাত্তাহু (الفتاح) আল্লাহর একটি পবিত্র নাম। বিয়ে ছাড়াও আল্লাহ তাআলার এই পবিত্র নাম ফজরের নামাজের পর দুই হাত বুকের উপর রেখে ৭১ বার পাঠ করলে অভাব দূর হবে,মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং সকল কাজ সহজ হবে ইনশাল্লাহ।

রাসুল সা. যেভাবে চুলের পরিচর্যা করতেন

news-image

মাথার চুল আল্লহপাকের এক বিশেষ নিয়ামত। এই চুল মানুষকে গরম ও ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করে। আবার এই চুল মানুষকে এক প্রকার সুন্দর অবায়বে উপস্থাপন করে। চুলে মানুষের চেহারার আকর্ষণ সৃষ্টি করে।

মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা হলো তার চুল থাকা। তাই ইসলাম চুল কাটারও অনুমতি দিয়েছে আবার চুল রাখারও অনুমতি দিয়েছে। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময়ই চুল রাখতেন এবং জীবনে কয়েকবার তিনি মুণ্ডনও করেছেন।

একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত জাফরের (রা.) ছেলের মাথা নিজ হাতে মুণ্ডন করে দিয়েছেন। (আবু দাউদ) তবে এই ক্ষেত্রে ইসলাম রুচিশীল মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেউ চুল রাখলে যেন যত্ন করে রাখে। (আবু দাউদ) অবশ্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথায় চিরুনি করা এবং সাজসজ্জা করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িকে পছন্দ করতেন না। তবে বিরতি দিয়ে মাথায় চিরুনি করতে বলেছেন।

আবু কাতাদাহর রা. একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, তার চুল বড় ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে প্রতিদিন চিরুনি করতে বলতেন। (নাসাঈ)

হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথায় অত্যধিক তেল ব্যবহার করতেন। (শামায়েলে তিরমিযি) মাঝে মধ্যে উম্মুল মুমিনীনগণও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাথায় চিরুনি করে দিতেন। (বুখারি) তাই মাথায় তেল ব্যবহার করা সুন্নাত বলার অনুমতি রয়েছে।

দাম্পত্য জীবন, অজ্ঞতা ও পরিণাম: মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ
শিক্ষক ও লেখক

কিছু দিন আগে আমার এক প্রিয় তালিবে ইলম দেখা করতে এসে বললো, হুযূর, আগামী পরশু আমার বিবাহ। চমকে উঠে তাকালাম। বড় ‘বে-চারা’ মনে হলো।কারণ আমিও একদিন বড় অপ্রস্ত্তত অবস্থায় জেনেছিলাম, আগামীকাল আমারবিবাহ! ভিতর থেকে হামদরদি উথলে উঠলো। ইচ্ছে হলো তাকে কিছু বলি, যিন্দেগিরএই নতুন রাস্তায় চলার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু পাথেয়, আল্লাহর তাওফীকে তাকে দান করি। আল্লাহর তাওফীক ছাড়া আমরা কেই বা কী করতে পারি!

তো তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বিবাহের জন্য কী প্রস্ত্ততি নিয়েছো? বড় ভোলাভালানও জোয়ান! সরলভাবে বললো, আমার কিছু করতে হয়নি, সব প্রস্ত্ততি আব্বা -আম্মাই নিয়েছেন। কেনা-কাটা প্রায় হয়ে গেছে, শুধু বিয়ের শাড়ীটা বাকি।

অবাক হলাম না, তবে দুঃখিত হলাম, আমার এই প্রিয় তালিবে ইলম এখন একজন যিম্মাদার আলিমে দ্বীন। দীর্ঘ কয়েক বছর আমাদের ছোহবতে ছিলো, তার কাছে বিবাহের প্রস্ত্ততি মানে হলো জিনিসপত্র এবং বিয়ের শাড়ী! তাহলে অন্যদের অবস্থা কী?!

বড় মায়া লাগলো; বললাম, দেখো, মানুষ যে কোন কাজ করতে চায়, প্রথমে সে ঐ বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে। কাজটির হাকীকত ও উদ্দেশ্য কী? কাজটি আঞ্জাম দেয়ার সঠিক পন্থা কী? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কী কী সমস্যা হতে পারে, সেগুলোর সমাধান কী? এগুলো জেনে নেয়। এজন্য দস্ত্তর মত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার আয়োজন আছে, এমনকি বাস্তব প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা আছে।

অথচ জীবনের সবচে’ কাঠিন ও জটিল অধ্যায়ে মানুষ প্রবেশ করে, বরং বলতে পারো ঝাঁপ দেয়, কিছু না শিখে, না জেনে এবং না বুঝে একেবারে অপ্রস্ত্তত অবস্থায়। ফল কী হতে পারে?! কী হয়?! অন্যদের কথা থাক, চোখের সামনে আমার ক’জন ছাত্রের ঘর ভেঙ্গে গেলো!

একজনের তো এমনকি দু’জন সন্তানসহ। কিংবা ঘর হয়ত টিকে আছে, কিন্তু শান্তি নেই। স্বাভাবিক শান্তি হয়ত বজায় আছে, কিন্তু বিবাহ যে দুনিয়ার বুকে মানবের জন্য আল্লাহর দেয়া এক জান্নাতি নেয়ামত, সুকূন ওসাকীনাহ, সে খবর তারা পায়নি, শুধু অজ্ঞতার কারণে, শুধু শিক্ষার অভাবে।

আশ্চর্য, মা-বাবা সন্তানকে কত বিষয়ে কত উপদেশ দান করেন; উস্তাদ কত কিছু শিক্ষা দেন, নছীহত করেন, কিন্তু জীবনের সবচে’ কঠিন ও জটিল বিষয়টি কেন যেন তারা সযত্নে এড়িয়ে যান!

তাকে বললাম, যদিও তুমি এ উদ্দেশ্যে আসোনি তবু তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, যা ইনশাআল্লাহ আগামী জীবনে তোমার কাজে আসবে।

খুব জযবা ছিলো, অবেগের তোড় ছিলো, ‘দিল কো নিচোড় ক্যর’, বাংলায় যদি বলি তাহলে বলবো, হৃদয় নিংড়ে, কিন্তু দিল কো নিচোড়না-এর ভাব হৃদয় নিংড়ানোতে আসবে কোত্থেকে!

যাক, বলছিলাম, হৃদয়টাকে নিংড়ে কিছু কথা তাকে বলেছিলাম।পরে আফসোস হলো যে, কথাগুলো তো সব হাওয়ায় উড়ে গেলো, যদি বাণীবদ্ধ করে রাখা যেতো কত ভালো হতো! হয়ত আল্লাহর বহু বান্দার উপকারে আসতো। শেষে বললাম, এক কাজ করো, এ কথা গুলোর খোলাছা কাগজে লিখে আমাকে দেখিও।

আগামী পরশুর বিয়ের খবর দিয়ে ছেলেটা সেই যে গেলো, তিন বছরে আর দেখা নেই! দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিভিন্ন সময় দরসেও আমি অনেক কথা বলেছি। ‘সবচে’ বেশী বলেছি আমার নূরিয়ার জীবনের প্রিয় ছাত্র (বর্তমানের হাতিয়ারহুযূর) মাওলানা আশরাফ হালীমীকে, আশা করি তিনি সাক্ষ্য দেবেন, অনেকবার বলেছেন, আমার কথাগুলো তার জীবনে বে-হদ উপকারে এসেছে। আরো অনেকে বলেছে, কিন্তু কথাগুলো কেউ ‘কলমবন্দ’ করেনি।

তো এখন এই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে তোমাদের মজলিসে ঐ কথাগুলো আবার বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আফসোস, সেই আবেগ ও জযবা তো এখন নেই যা ঐ প্রিয় তালিবে ইলমকে বলার সময় ছিলো। আবেগভরা দিলের কথা তো রসভরা ইক্ষু, আর শুধু চিন্তা থেকে বলা কথা হলো রস নিংড়ে নেয়া ইক্ষুর ছোবা! তবু কিছু না কিছু ফায়দা তো ইনশাআল্লাহ হবে।

আমি আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বলেছিলাম, এখন তোমার জীবনের এই যে নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে উর্দূতে এটাকে বলে ইযদিওয়াজী যিন্দেগী, বাংলায় বলে দাম্পত্যজীবন, অর্থাৎ এটা জীবন ও যিন্দেগির খুবই এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অত্যন্ত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ।

এটা তোমাকে ঘাবড়ে দেয়ার জন্য বলছি না; প্রয়োজনীয় প্রস্ত্ততি গ্রহণ ও পাথেয় সংগ্রহ করার জন্য বলছি, যাতে পূর্ণআস্থা ও সাহসের সঙ্গে তুমি তোমার এই নতুন জীবন শুরু করতে পারো। আল্লাহ যদি সাহায্য করেন তাহলে সবই সহজ।

এটা যে শুধু তোমার ক্ষেত্রে হচ্ছে তা নয়! আমার জীবনেও হয়েছে, আমার মা-বাবার জীবনেও হয়েছে! তোমার মা-বাবাও একদিন এ জীবন শুরু করেছিলেন। যদি সহজও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকে তাহলে তোমার মাকে, বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে পারো, কীভাবে তারা এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন? জীবনের শুরুতে তারা কীভাবে ছিলেন, কী চেয়েছিলেন, কী পেয়েছেন?

কখন কী সমস্যা হয়েছে, সেগুলো কীভাবে সমাধান করেছেন। এই জীবনের শুরুতে তোমার প্রতি তাদের কী উপদেশ? এ ধরনের সহজ আন্তরিক আলোচনায় সংসার জীবনের পথচলা অনেক সহজ হয়ে যায়। অবশ্য সব মা-বাবার সঙ্গে সব সন্তানের এমন সহজ সম্পর্ক থাকে না, তবে থাকা উচিত।

জীবনের যে কোন সমস্যার সমাধানের জন্য সন্তান মা-বাবার কাছেই আসবে, মা-বাবাকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করবে, বন্ধু বান্ধবকে নয়। কঠিন সমস্যার মুখে একজন অপরিপক্ব বন্ধু কীভাবে সঠিক পথ দেখাতে পারে! কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটাই ঘটে।

সন্তান মা-বাবাকে ভয় করে, হয়ত কোন জটিলতায় পড়েছে; তখন তাদের প্রথম চেষ্টা হয় যে, মা-বাবা যেন জানতে না পারে, কারণ তাদের কানে গেলে সর্বনাশ! ছেলে তার বন্ধুর শরণাপন্নহয়, মেয়ে তার বান্ধবীর কাছে বলে, তারা তাদের মত করে পরামর্শ দেয়। ফলে অবস্থা আরো গুরুতর হয়।

অতীতে যাই ছিলো, এখন তো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, মা-বাবার জন্য সন্তানের বন্ধু হওয়া। বিপদে সমস্যায় সন্তানকে তিরস্কার পরে করা, আগে তার পাশে দাঁড়ানো। তাহলে সন্তান আরো বড় অন্যায় করা থেকে এবং আরো গুরুতর অবস্থায় পড়া থেকে বেঁচে যায়।

কিন্তু এখন অবস্থা হলো, সন্তান মা-বাবাকে ভয় করে, বন্ধুকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করে। আমার ছেলেকে আমি এটা বোঝাতে চেয়েছি এবং আশা করি, কিছুটা বোঝাতে পেরেছি। অনেক সমস্যা থেকে সে রক্ষা পেয়েছে, কারণ সবার আগে সে আমার কাছে এসেছে, আর আমি বলেছি, ভয় নেই, আমি তোমার পাশে আছি। আগে তাকে সাহায্য করেছি, তারপর প্রয়োজনে দরদের সঙ্গে তিরস্কার করেছি, বা শিক্ষা দিয়েছি।

বন্ধুর কাছে আগে পাওয়া যায় সাহায্য, মা-বাবার কাছ থেকে আগে আসে তিরস্কার। তাই সন্তান সমস্যায় পড়ে মা-বাবার কাছেআসে না, বন্ধুর কাছে আসে। এভাবে নিজের কারণেই সবচে’ কাছের হয়েও মা-বাবা হয়ে যায় দূরের, আর দূরের হয়েও বন্ধু হয়ে যায় কাছের। সন্তানের সমস্যা বন্ধু জানে সবার আগে। মা-বাবা জানে সবার পরে, পানি যখন মাথার উপর দিয়ে চলে যায় তখন।

তো আমি আশা করছি, জীবনের অন্যসকল ক্ষেত্রে যেমন তেমনি, আল্লাহ না করুন দাম্পত্য জীবনে যদি কোন রকম সমস্যার সম্মুখীন হয় তাহলে সন্তান সবার আগে আমার কাছে আসবে, তার মায়ের কাছে আসবে, আমাদের উপদেশ, পরামর্শ নেবে। আলহামদুলিল্লাহ, সেই রকমের সহজ অন্তরঙ্গ সম্পর্কই সন্তানের সঙ্গে আমার, আমাদের।

আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বললাম, কথা অন্য দিকে চলে গেছে, তো এই প্রসঙ্গে তোমাকে একটি আগাম নছীহত করি; আজ তোমরা স্বামী-স্ত্রী, দু’দিন পরেই হয়ে যাবে, মা এবং বাবা। সেটা তো জীবনের আরো কঠিন, আরো জটিল অধ্যায়।

আমি প্রায় বলে থাকি, প্রাকৃতিক নিয়মে মা-বাবা হয়ে যাওয়া খুব সহজ। কিন্তু আদর্শ মা-বাবা হওয়ার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ শিক্ষা ও দীক্ষা। তো তোমরা দু’জন জীবনের শুরু থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করো যে, একটি মেয়ে কীভাবে একজন আদর্শ মা হতে পারে এবং একটি ছেলে কীভাবে একজন আদর্শ বাবা হতে পারে! আগে বলেছিলাম একটি নছীহত, এখন বলছি দু’টি নছীহত।

সন্তানের সামনে কখনো তার মাকে অসম্মান করো না। তোমাকে মনে রাখতে হবে, সে তোমার স্ত্রী, কিন্তু তোমার সন্তানের মা, তোমার চেয়েও অধিক শ্রদ্ধার পাত্রী।সন্তান যেন কখনো, কখনোই মা-বাবাকে ঝগড়া-বিবাদ করতে না দেখে।

এ নছীহত আমি তোমাকে করছি, আল্লাহর শোকর নিজে আমল করে। আমার বড় সন্তানের বয়স ত্রিশ বছর, এর মধ্যে কখনো সে আমাদের বিবাদ করতে এমনকি তর্ক করতেও দেখেনি। দ্বিতীয়ত তোমরা উভয়ে সন্তানের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করো, এমন বন্ধু যাকে নিজের মনের কথা, সব কথা নিঃসঙ্কোচে জানাতে পারে।

আগের কথায় ফিরে আসি; আগামীপরশু তোমার বিবাহ। তার মানে, আজ তুমি নিছক একটি যুবক ছেলে, অথচ আগামী পরশু হয়ে যাচ্ছো, একজন দায়িত্ববান স্বামী। কত বিরাট পার্থক্য তোমার আজকের এবং আগামী পরশুর জীবনের মধ্যে।বিষয়টি তোমাকে বুঝতে হবে। কেন তুমি বিবাহ করছো? বিবাহের উদ্দেশ্য কী?

দেখো, আমাদের দেশে পারিবারিক পর্যায়ে একটা নিন্দনীয় মানসিকতা হলো, সংসারের প্রয়োজনে, আরো খোলামেলা যদি বলি, কাজের মানুষের প্রয়োজনে ছেলেকে বিয়ে করানো। সবাই যে এমন করে তা নয়, তবে এটা প্রবলভাবে ছিলো, এখনো কিছু আছে।

আমি নিজে সাক্ষী, আমার একজন মুহতারাম তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিলেন, বিয়ে হওয়া মাত্র ছেলের বাবা স্বমূর্তি ধারণ করে বলতে লাগলেন, আর দেরী করা যাবে না, তাড়াতাড়ি মেয়ে বিদায় করেন। মেয়ের মা ও বাবা তো হতবাক!

মেয়ে বিদায় হলো। শশুরবাড়ীতে রাত পোহালো, আর পুত্রবধুর সামনে কাপড়েরস্ত্তপ নিক্ষেপ করে শাশুড়ী আদেশ করলেন, কাপড়ে সাবান লাগাও, দেখি, মায়েরবাড়ী থেকে কেমন কাজ শিখে এসেছো!

আমার এক ছাত্রের কথা, বিয়ের প্রয়োজন। কেন? কারণ মা-বাবার খেদমত করার কেউ নেই।

এটা কিন্তু বিবাহের উদ্দেশ্য বা মাকছাদ হতে পারে না। মা-বাবার খেদমত মূলত তোমার দায়িত্ব। এখন সে যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তোমার সাথে এতে শরীক হয়, তবে সেটা তোমাদের উভয়ের জন্য সৌভাগ্যের কারণ হতে পারে।

দেখো, আল্লাহ চাহেতো অচিরেই আমাদেরও ঘরে পুত্রবধু আসবে। আমরা আমাদের না দেখা সেই ছোট্ট মেয়েটির প্রতীক্ষায় আছি। কিন্তু আমি আমার পুত্রকে অবশ্যই বলবো, বিবাহের উদ্দেশ্য মা-বাবার খেদমত করা হতে পারে না।

আমি দু’আ করি, তোমার মা-বাবা তোমার যেমন, তেমনি তোমার স্ত্রীরও যেন মেহেরবান মা-বাবা হতে পারেন। আমার দুই মেয়ের শশুর, দু’জনই এখন জান্নাতবাসী (ইনশাআল্লাহ)।

আল্লাহর কাছে আমার সাক্ষ্য এই যে, সত্যি সত্যি তারা আমার মেয়েদু’টির ‘বাবা’ ছিলেন। আমার ছোট মেয়ের শশুর বড় আলিম ছিলেন, তাঁকে আমার একটি বই হাদিয়া দিয়েছিলাম এভাবে, ‘সাফফানার আব্বুর পক্ষ হতে সাফফানার আব্বাকে’। তিনি খুশী হয়ে অনেক দু’আ করেছিলেন, আর বলেছিলেন, ‘আপনি তো এই ছোট্ট একটি বাক্যে সম্পর্কের মহামূল্যবান এক দর্শন তুলে ধরেছেন!

আমার বড় মেয়ের অবস্থা হলো, মায়ের বাড়ী থেকে যাওয়ার সময় সে কাঁদে না, কাঁদে ‘আম্মার’ বাড়ী থেকে আসার সময়।

দুআ’ করি, আমার দেশের প্রতিটি মেয়ে যেন মা-বাবার ঘর থেকে এমন মা-বাবার ঘরে প্রবেশ করতে পারে। আর তুমি দু’আ করো, আমরা দু’জন যেন আমাদের অনাগত মেয়েটির জন্য তেমন মা-বাবাই হতে পারি।

তো বলছিলাম বিবাহের উদ্দেশ্যের কথা। বৈধ উপায়ে স্ত্রী পরিচয়ে কাউকে ভোগকরা, এটাও বিবাহের উদ্দেশ্য বা মাকছাদ হতে পারে না।

স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে বলা হয় শরীকে হায়াত, জীবনসঙ্গী এবং জীবনসঙ্গিনী।বস্ত্তত এই শব্দটির মধ্যেই দাম্পত্য জীবনের সুমহান উদ্দেশ্যটি নিহিত রয়েছে।আর যদি কোরআনের ভাষায় বলি তাহলে বিবাহের উদ্দেশ্য হল,

هن لباس لكم وانتم لباس لهن

তুমি তো কোরআন বোঝো। ভেবে দেখো, দাম্পত্য-সম্পর্কের কী গভীর তাৎপর্য এখানে নিহিত!

পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিবাহ হচ্ছে আমার সুন্নত।আর বলেছেন, যে আমার সুন্নতের প্রতি বিমুখ হবে সে আমার উম্মতভুক্ত নয়।

বিবাহ নবীর সুন্নত! সুতরাং সহজেই বোঝা যায়, বিরাট ও মহান কোন মাকছাদ রয়েছে এর পিছনে।

বিবাহের আসল মাকছাদ বা উদ্দেশ্য হলো স্বামী ও স্ত্রী- এই পরিচয়ে একটি নতুন পরিবার গঠন করা এবং মা ও বাবা- এই পরিচয়ে সন্তান লাভ করা। তারপর উত্তমলালন-পালন এবং আদর্শ শিক্ষা-দীক্ষা ও তারবিয়াতের মাধ্যমে নেক সন্তানরূপে গড়ে তুলে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করা, যাতে নস্লে ইনসানি বা মানব বংশ কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর পছন্দমত আগে বাড়তে থাকে।

এটাই হলো বিবাহের আসল উদ্দেশ্য; অন্য যা কিছু আছে তা সব পার্শ্ব-উদ্দেশ্য। তো এখনই তুমি নিয়ত ঠিক করে নাও যে, কেন কী উদ্দেশ্যে বিবাহ করবে।

উদ্দেশ্য যদি ঠিক হয়ে যায় তাহলে দেখতে পাবে, আল্লাহ চাহে তো এখনই তোমার ভিতরে কত সুন্দর পরিবর্তন আসছে! কী আশ্চর্য এক পরিপূর্ণতা নিজের মধ্যে অনুভূত হচ্ছে! আগামী জীবনের সকল দায়দায়িত্ব পালন করার জন্য গায়ব থেকে তুমি আত্মিকশক্তি লাভ করছো। আল্লাহ তাওফীক দান করেন।

এবার আসো জীবনের বাস্তবতার কথা বলি, এতদিন তোমার জীবনে ছিলেন শুধু তোমার মা, যিনি তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন, প্রসববেদনা ভোগ করেছেন। নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করে তোমাকে প্রতিপালন করেছেন।

এতদিন তোমার উপর ছিলো তাঁর অখন্ড অধিকার।হঠাৎ তিনি দেখছেন, তাঁর আদরের ধন, তাঁর অাঁচলের রত্ন পুত্রের জীবনে স্ত্রী পরিচয়ে অন্য এক নারীর প্রবেশ (অনুপ্রবেশ?) ঘটেছে! এভাবে পুত্রের উপর তার অখন্ড অধিকার খন্ডিত হতে চলেছে। যে পুত্র ছিলো এতদিন তাঁর একক অবলম্বন, এখন সেহতে চলেছে অন্য এক নারীর অবলম্বন।

এ বাস্তবতা না তিনি অস্বীকার করতে পারছেন, না মেনে নিতে পারছেন। সংসারে প্রত্যেক মায়ের জীবনে এ কঠিন সময়টি আসে। এমন এক অর্ন্তজ্বালা শুরু হয় যা শুধু তিনি নিজেই ভোগ করেন, কাউকে বোঝাতে পারেন না, এমনকি এতদিনের আদরের ধন পুত্রকেও না।

ফলে সামান্যসামান্য কারণে, এমনকি অকারণেও তিনি খুব সংবেদনশীল হয়ে পড়েন; তাঁর অনুভূতি আহত হয়। এমন সময় ছেলে (এবং তার স্ত্রী অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা ও অপিরপক্বতার কারণে) যদি অসঙ্গত কিছু বলে বা করে বসে তাহলে তো মায়ের মনে কষ্টের শেষ থাকে না। প্রসববেদনা থেকে শুরু করে প্রতিপালনের সব কষ্ট একসঙ্গে মনে পড়ে যায়।

আম্মার কাছে শুনেছি, গ্রামের এক মা তার পুত্রবধুকে বলেছিলেন, ‘ততা ফানি আমি খাইছিলাম, না তুই খাইছিলি?’

তখনকার যুগে প্রসবপরবর্তী বেশ কিছু দিন মা ও শিশুর স্বাস্থ্যগত কল্যাণ চিন্তা করে মাকে গরম পানি খেতে দেয়া হতো, ঠান্ডা পানি দেয়া হতো না।

তো কথাটা কিন্তু নির্মম। আমার জন্য ‘তাতানো পানি’ আমার মা খেয়েছেন, আমার সব আবর্জনা আমার মা পরিস্কার করেছেন। নিজের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে তিনি আমাকে বড় করেছেন, উপযুক্ত করেছেন।

সেই সব কষ্টের সুফল হঠাৎ করে অন্য একটি মেয়ে এসে অধিকার করে বসেছে। তখন সব হারানোর একটা বেদনাতাকে কুরে কুরে খায়। তো তোমার মায়ের অন্তরেও এরকম অনুভূতি হওয়াস্বাভাবিক। মায়ের মনের এই কষ্টের উপশম, এই বেদনার সান্ত্বনা তোমাকেই চিন্তা করতে হবে।

মায়ের পর দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে বাবার কথা, তারপর ভাই-বোনদের কথা। (এসম্পর্কেও ছাত্রটিকে বিশদভাবে বলেছিলাম।)

তৃতীয়ত তোমার স্ত্রী। যদিও তৃতীয় বলছি, কিন্তু বাস্তবে এটাই হলো সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচে’ নাযুক। তবে এটা থাকবে তোমার দিলে, তোমার অন্তরে। মা-বাবার সামনে মুখের কথায় বা আচরণে এটা প্রকাশ করা প্রজ্ঞার পরিচায়ক হবে না।

কেন বলছি স্ত্রীর বিষয়টি সবচে’ নাযুক? তার আগে আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দাও; কোন বিবাহে কোন ছেলেকে কাঁদতে দেখেছো?! কোন ছেলের মা-বাবাকে বিষণ্ণ দেখেছো?! দেখোনি; (হয়তো ব্যতিক্রম এক দুইটি ঘটনা থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণ অবস্থা এটিই, এদের কেউ কাঁদে না।) কেন? কারণ বিবাহের মাধ্যমে ছেলে কিছু হারায় না, ছেলের মা-বাবা কিছু হারায় না, বরং অর্জন করে। তাই তাদের মুখে থাকে অর্জনের হাসি এবং প্রাপ্তির তৃপ্তি।

বিবাহের আসরে কাঁদে শুধু মেয়ে, আর মেয়ের মা-বাবা। কেন কাঁদে একটি মেয়ে? কারণ তাকে সবকিছু হারাতে হয়, সবকিছু ত্যাগ করতে হয়। মা-বাবাকে ছেড়ে আসতে হয়, শৈশবের সব স্মৃতি তাকে মুছে ফেলতে হয়।

একটি ছোট্ট মেয়ের জীবনে এটি অনেক বড় আঘাত। এ যেন একটি ছোট্ট গাছের চারাকে শিকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলে বহু দূরে ভিন্ন পরিবেশে নতুন মাটিতে এনে রোপণ করা। বাকি জীবন তাকে এই মাটি থেকেই রস আহরণ করে বেঁচে থাকতে হবে।

হিন্দিতে বলে, ‘আওর‌্যত কী ডোলী যাহা উত্যরতী হ্যয়, উসকী আর্থী ওহীঁ সে উঠতি হ্যয়।’ অর্থাৎ মেয়েদের পালকি যেখানে গিয়ে নামে, সেখান থেকেই তার জানাযা ওঠে।

কত বড় নির্মম সত্য! তো তোমার স্ত্রীরূপে তোমার ঘরে আসা এই ছোট্ট মেয়েটির যখমি দিলে তাসাল্লির মরহম তোমাকেই রাখতে হবে। এক মাটি থেকে উপড়ে এনে আরেক মাটিতে রোপণ করা একটি চারাগাছ থেকে দু’দিন পরেই ফল দাবী করা কতটা নিষ্ঠুরতা!

ফল পেতে হলে তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। চারা গাছটির পরিচর্যাকরতে হবে, সকাল-সন্ধ্যা তার গোড়ায় পানি দিতে হবে। ধীরে ধীরে শিকড় যখন মাটিতে বসবে এবং মাটি থেকে রস সংগ্রহ করার উপযুক্ত হবে, তখন তোমাকে ফল চাইতে হবে না; সজীব বৃক্ষ নিজে থেকেই ফল দিতে শুরু করবে।

কত আফসোসের বিষয়, দাম্পত্য জীবনের শুরুতে যত আদেশ-উপদেশ সব ঐ ছোট্ট মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বর্ষিত হয়। প্রথম দিনেই তাকে শুনতে হয়, এখন থেকে তাকে স্বামীর মন জয় করতে হবে, শশুর-শাশুড়ি সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে, শশুর বাড়ীর সবার মন যুগিয়ে চলতে হবে। তার নিজের যেন কোন ‘মন’ নেই।সুতরাং সেটা জয় করারও কারো গরজ নেই।

তো মায়ের মন তোমাকেই রক্ষা করতে হবে, আবার স্ত্রীর মনোরঞ্জনও তোমাকেই করতে হবে। সবদিক তোমাকেই শামাল দিয়ে চলতে হবে। কত কঠিন দায়িত্ব! অথচ না শিক্ষাঙ্গনে, না গৃহপ্রাঙ্গণে, কোথাও এ সম্পর্কে শিক্ষার নূন্যতম কোন ব্যবস্থা নেই।

সম্পূর্ণ অপ্রস্ত্তত অবস্থায় দু’টি অপরিপক্ব তরুণ-তরুণীকে যেন সংসার সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া! মেয়েটিও জানে না, আজ থেকে সে আর ছোট্ট মেয়েটি নেই। সে এখন স্ত্রী হয়ে একটি অপরিচিত মানুষের জীবনে প্রবেশ করছে, যার মা আছে, বাবা আছে, ভাইবোন আছে এবং তাদের প্রতি তার স্বামীর অনেক দায়-দায়িত্ব আছে।সহানুভূতির সঙ্গে কোমলাতার সঙ্গে এই দায়িত্ববোধ কেউ তার মধ্যে জাগ্রত করে দেয়নি। এ দোষ কার!

তো আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বলেছিলাম, কথা দ্বারা আচরণ দ্বারা তোমার মাকে তুমি বোঝাবে, মা, আমি আপনারই ছিলাম, আছি এবং থাকবো। স্ত্রী হলো আমার জীবনের নতুন প্রয়োজন; আপনি আমার প্রাণ, আপনার সঙ্গে আমার নাড়ির টান।

অন্যদিকে স্ত্রীকে বোঝাতে হবে, এই সংসার সমুদ্রে তুমি একা নও; আমি তোমার পাশে আছি। নতুন জীবনে চলার পথে আমারও অনেক কষ্ট হবে, তোমারও অনেককষ্ট হবে। তবে সান্ত্বনা এই যে, তুমিও একা নও, আমিও একা নই। আমার পাশে তুমি আছো, তোমার পাশে আমি আছি। আমার কষ্টের সান্ত্বনা তুমি, তোমার কষ্টের সান্ত্বনা আমি। আমরা পরস্পরের কষ্ট হয়ত দূর করতে পারবো না, তবে অনুভব করতে পারবো এবং হয়ত কিছুটা লাঘব করতে পারবো।

আল্লাহর কসম, এমন কোন নারিহৃদয় নেই যা এমন কোমল সান্ত্বনায় বিগলিত হবেনা।

তোমার স্ত্রীকে তুমি এভাবে বলবে, আমাদের জীবন তো আলাদা ছিলো। আমরা তো একে অপরকে চিনতামও না। আল্লাহ আমাদের কেন একত্র করেছেন জানো?! একাএকা জান্নাতে যাওয়া কঠিন। আল্লাহ আমাদের একত্র করেছেন একসঙ্গে জান্নাতের পথে চলার জন্য।

আমি যদি পিছিয়ে পড়ি, তুমি আমাকে টেনে নিয়ে যাবে; তুমি যদি পিছিয়ে পড়ো, আমি তোমাকে টেনে নিয়ে যাবো। তুমি সতর্ক থাকবে, আমার দ্বারা যেন কারো হক নষ্ট না হয়; আমিও সতর্ক থাকবো, তোমার দ্বারা যেন কারো প্রতি যুলুম না হয়।

প্রিয় ছাত্রটিকে আমি আরো বললাম, স্ত্রীকে বোঝানোর জন্য তার সন্তানকে সামনে আনতে হবে। অর্থাৎ তুমি তাকে বলবে, দেখো, জীবন কত গতিশীল! সবকিছু কতদ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে! দু’দিন আগে আমরা শুধু যুবক-যুবতী ছিলাম, আজ হয়ে গেছি স্বামী-স্ত্রী। দু’দিন পরেই হয়ে যাবো মা-বাবা। আমি বাবা, তুমি মা! আল্লাহর কাছে একজন মায়ের মর্যাদা কত! তোমার কদমের নীচে হবে তোমার সন্তানের জান্নাত! যেমন আমার মায়ের কদমের নীচে আমার জান্নাত।

তো তোমার সন্তান কেমন হলে তুমি খুশী হবে? আমাকেও আমার মায়ের ঐরকম সন্তান হতে তুমি সাহায্য করো।আমি যদি ভুল করি, মায়ের কোন হক নষ্ট করি, মায়ের সামনে ‘উফ’ করি, তুমিআমাকে সাবধান করো, আমাকে সংশোধন করো। তাহলে ইনশাআল্লাহ তোমার সন্তানও তুমি যেমন চাও তেমন হবে।

প্রয়োজন হলে স্ত্রীকে মা-বাবার সামনে তিরস্কার করবে, তবে ঘরে এসে একটু আদর, একটু সোহাগ করে বোঝাতে হবে, কেন তুমি এটা করেছো?! বোঝানোর এই তরযগুলো শিখতে হবে, আর এটা দু’একদিনের বিষয় নয়, সারা জীবনের বিষয়।

কিন্তু আমরা ক’জন এভাবে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করি?! হয় মাতৃভক্তিতে স্ত্রীরপ্রতি অবিচার করি, না হয়, স্ত্রীর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে মা-বাবার দিলে আঘাত দেই, আর দুনিয়া-আখেরাত বরবাদ হয়। আমার একটা কথা মনে রেখো, মায়ের পক্ষ নিয়ে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করা মূলত মায়ের প্রতি যুলুম, তদ্রূপ স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে মায়ের হক নষ্ট করা আসলে স্ত্রীর প্রতি যুলুম। আমার একথার উৎস হলো,

أنصر أخاك ظالما أو مظلوما

অবশ্য সবকিছু হতে হবে হিকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে।

একটি ঘটনা তোমাকে বলি, তোমার মত আলিমে দ্বীন নয়, সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতএকজন মানুষ আমাকে বলেছেন, একবার তার মা তাকে বললেন, তোর বউ আজ তোর এত আপন হয়ে গেলো কীভাবে!

আমি বললাম, দেখো মা, তোমাকে আমি মা বলি; এই ‘মা’ ডাকটুকু পাওয়ার জন্য তোমাকে কত কষ্ট করতে হয়েছে! অথচ ‘পরের বাড়ীর মেয়েটি’র মুখ থেকে তুমি বিনা কষ্টে ‘মা’ ডাক শুনতে পাও! তোমাকে যে মা বলে ডাকে সে আমার আপন হবেনা কেন মা?

আরেকটা ঘটনা, এক মা তার মেয়ের শাশুড়ী সম্পর্কে বললেন, মানুষ না, মেয়েটাকে আনতে পাঠালাম, দু’টো পিঠে বানিয়ে খাওয়াবো, দিলো না, ফেরত পাঠিয়ে দিলো!

দু’দিন আগে তিনিও একই কাজ করেছিলেন, ছেলের বউকে নিতে এসেছিলো মায়ের বাড়ী থেকে। তিনি বললেন, দু’দিন পরে আমার মেয়েরা আসবে এখন তুমি গেলে কীভাবে চলবে!

ভদ্র মহিলাকে বললাম, আপনার কাজটা কি ঠিক হয়েছিলো? আপনাকে কষ্ট দেয়াআমার উদ্দেশ্য নয়, সতর্ক করা উদ্দেশ্য। আল্লাহর কাছে যদি আটকা পড়েন তখন তো আপনিই বলবেন, তুমি তো হাদীছ-কোরআন পড়েছো, আমাকে সতর্ক করোনি কেন?

মোটকথা, মেয়েদেরকে তারবিয়াত করতে হবে যাতে তারা আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মা এবংআদর্শ শাশুড়ীরূপে আদর্শ জীবন যাপন করতে পারে। পুরুষ হচ্ছে কাওয়াম ও পরিচালক। সুতরাং তারবিয়াত ও পরিচালনা করা পুরুষেরই দায়িত্ব।

স্ত্রী, মা ওশাশুড়ী, জীবনের এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন ধাপের জন্য ঘরে ঘরে আমরা যদি আমাদের মেয়েদের গড়ে তুলতে পারি, আদেশ দ্বারা, উপদেশ, সর্বোপরি নিজেদের আচরণ দ্বারা তাহলেই সংসার হতে পারে সুখের, শান্তির।

প্রিয় ছাত্রটিকে আরেকটি কথা বললাম, তোমার স্ত্রীর কোন আচরণ তোমার অপছন্দহতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথমে তোমাকে ভাবতে হবে, তোমার সব আচরণ কি সুন্দর, তোমার স্ত্রীর পছন্দের? তাছাড়া তোমার স্ত্রীর ভালো দিক কি কিছু নেই। সেই ভালোদিকগুলোর জন্য শোকর করো, আর যা তোমার কাছে মন্দ লাগে তার উপর ছবর করো।

আর যদি সংশোধন করতে চাও তাহলে ভালো দিকগুলোর প্রশংসা করো, তারপর কোমল ভাষায় বলো, তোমার এই বিষয়টা যদি না থাকতো তাহলে তুমি আরো অনেক ভালো হতে।

তবে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামের সেই প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ মনে রাখতে হবে, একটু বাঁকা থাকবেই, এই বক্রতা, সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে নায, আন্দায, মান, অভিমান, লাস্যতা, এই বক্রতা নারীর সৌন্দর্য, নারীর শক্তি।

এটাকে সেভাবেই গ্রহণ করে তার সঙ্গে জীবনযাপন করতে হবে, পূর্ণ সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে যাবে, আর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে।

সত্যি সত্যি যদি তোমার স্ত্রীর গুরুতর কোন ত্রুটি থাকে তবে সেটা সংশোধনেরদায়িত্ব ও কর্তব্য অবশ্যই তোমার। তবে সেক্ষেত্রেও সংশোধনের জন্য অত্যন্ত ধৈর্যেরসঙ্গে দিনের পর দিন চেষ্টা করে যেতে হবে। ধমক দিয়ে, জোর খাটিয়ে সংশোধনকরা যায় না, ঘরে অশান্তি আনা যায়, ঘর ভাঙ্গা যায়, আর সন্তানদের জীবনে বিপর্যয়আনা যায়।

ইসলামপুরে আমার আববার দোকানের অপর দিকে এক ভদ্রলোকের দোকান ছিলো। অবস্থা ছিলো এই যে, দোকানে বসেই মদ খেতো। আববা তাকে দাওয়াত দিলেন, আর সে খুব দুর্ব্যবহার করলো, কিন্তু আববা ধৈর্যের সঙ্গে দাওয়াত চালিয়ে গেলেন। দু’বছর পর তিনি মসজিদমুখী হলেন এবং এমন মুবাল্লিগ হলেন যে, বউকে তালাক দেবেন। কারণ সে দ্বীনের উপর আসছে না।

আববা তাকে এভাবে বুঝালেন, ‘আমার সঙ্গে আপনার আচরণ কি মনে আছে? আমি যদি ধৈর্যহারা হয়ে আপনাকে ত্যাগ করতাম! এই পুরো কথাটা যেহেনে রেখে স্ত্রীকে তালিম করতে থাকেন। ছবর করেন, ছবর করলে আমার প্রতি আপনার যুলুম আল্লাহ মাফ করবেন।

আল্লাহ যদি প্রশ্ন করেন আমার বান্দা তোমাকে আমার ঘরের দিকে ডেকেছে, তুমি তার প্রতি যুলুম করেছো কেন? তখন আপনি বলতে পারবেন, হেআল্লাহ, আমিও আপনার বান্দীর পিছনে ছবরের সঙ্গে মেহনত করেছি।’

সেই লোকের স্ত্রী কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরদানশীন হয়েছিলো। অথচ জোশের তোড়ে লোকটা তো ঘরই ভেঙ্গে ফেলছিলো। আসলে দোষ আমাদের। আমরা তারবিয়াত করার তরীকা শিখিনি। বোঝানোর তরয আয়ত্ত্ব করিনি।

প্রিয় ছাত্রটিকে আরো অনেক কথা বলেছিলাম, প্রায় দু’ঘণ্টা সময় তার জন্য ব্যয় করেছিলাম। সবকথা এখন মনেও নেই।

তবে একটা কথা তাকে বলা হয়নি, এখন তোমাদের মজলিসে বলি, স্ত্রীর সঙ্গে আচরণ কেমন হবে, এ সম্পর্কে একজনকে যা বলতে শুনেছিলাম, তা ছিল খুবই মর্মান্তিক। তিনি বলেছিলেন, ‘মেয়েলোক যেন তোমার মাথায় চড়ে না বসে, তাই প্রথম দিন থেকেই তাকে শাসনের মধ্যে রাখবা। পূর্ণ ইতা‘আত ও আনুগত্য আদায়করে নিবা, গোরবা কুশতান দর শবে আওয়াল।’

এ প্রবাদ এমনই বিশ্ববিশ্রুত যে, আমাদের নিরীহ বাংলাভাষায়ও বলে, ‘বাসর রাতেই বেড়াল মারতে হবে’। কিন্তু জীবনের সর্বক্ষেত্রের মত এক্ষেত্রেও আমাদেরঅনুসরণীয় হলো সুন্নাতে রাসুল, আর তিনি ইরশাদ করেছেন,

خيركم خيركم لأهله وأنا خيركم لأهلي

তো জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শরীয়তের সীমারেখায় থেকে স্ত্রীর সঙ্গে এমন আচরণই আমাকে করতে হবে, যাতে সে মনে করে, আমি সর্বোত্তম স্বামী, আমার মতো উত্তম স্বামী হয় না, হতে পারে না।

স্ত্রীগণের সঙ্গে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ কী ছিলো তা জানতে হবে এবং অনুসরণ করতে হবে। স্বামীর খেদমত করার মাধ্যমে স্ত্রী অনেক আজর ও ছাওয়াবের অধিকারিণী হতে পারে, এটা আলাদা কথা।

তবে আমাকে মনে রাখতে হবে যে, এটা স্ত্রীর মহত্ত্ব, স্বামীর অধিকার নয়। তারা যদি কখনো মায়ের বাড়ী যেতে চায়, আমরা প্রশ্ন করি, ‘আমার খাওয়া-দাওয়ার কী হবে?’ অথচ এটা তার বিবেচনারবিষয় হতে পারে, আমার প্রশ্ন করার বিষয় নয়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সামান্য কথা বলেই মজলিস শেষ করছি। সহবাস দাম্পত্য জীবনের একটি অপরিহার্য সত্য। এ বিষয়ে আলোচনাকে হায়া-শরমের খেলাফ মনে করা হয়। ফলে বিষয়টি অজ্ঞতার মধ্যে থেকে যায়। একারণে এমনকি অনেক সময় দাম্পত্য জীবন বিষাক্ত হয়ে পড়ে।

স্ত্রী তোমার সারা জীবনের সম্পদ এবং সেরা সম্পদ।

متاع মানে সম্পত্তি নয়, ভোগের বস্ত্ত নয় متاع মানে সম্পদ, ঐশ্বর্য। বিষয়টি বুঝতেনা পেরে আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা হাদীছের সমালোচনা করেন। আমরা হাদীছটির তরজমা ও ব্যাখ্যা এমন খন্ডিতভাবে করি যে, তারাও সুযোগ পেয়ে যায়।

তো স্ত্রী তোমার সম্পত্তি নয়, স্ত্রী হলো তোমার জীবনের সর্বোত্তম সম্পদ, যাযথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে তোমাকে রাখতে হবে এবং ব্যবহার করতে হবে।

প্রথমেই বর্বর ও পাশবিকরূপে নিজেকে স্ত্রীর সামনে তুলে ধরা বিরাট মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। স্ত্রী স্বামীর ভোগের পাত্রী নয়, বরং স্বামী-স্ত্রী হলো পরস্পরকে উপভোগ করার জন্য। যত দিন লাগে, দীর্ঘ সাধনা করে প্রথমে হৃদয় জয় করো, মনের দুয়ার খোলো, অন্তরের গভীরে প্রবেশ করো।

যিন্দেগীর এই কঠিন মারহালা সম্পর্কে কত কিছু যে বলার আছে, কত কিছু যে শেখার আছে! দেখি, যদি আবার কখনো সুযোগ হয়।

[দাম্পত্যজীবন সুখময় হওয়ার জন্য শুধু পুরুষের প্রচেষ্টা ও সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, নারীরও সদিচ্ছা ও সচেতনতা অতি প্রয়োজন।

এ বিষয়ে তারও আছে অনেক দায়িত্ব। কিন্তু নারীর তালীম-তরবিয়তের ভারও তো পুরুষেরই উপর। বিয়ের আগে পিতা-মাতা তার তরবিয়ত করবেন, বিয়ের পর স্বামী।দাম্পত্য জীবনে নারীর দায়িত্ব কী কী, সেই সকল দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে সচেতন করার পদ্ধতি কী এবং তার তালীম-তরবিয়ত কীভাবে করতে হবে-এটি আলাদা একটি বিষয়।

আল্লাহ করুন, কোনো মজলিসে আমরা যেন হুজুরের কাছ থেকে এ বিষয়েও বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা লাভ করি।-তত্ত্বাবধায়ক] সৌজন্যে- মাসিক আল-কাউসার।